ফিকশন
বাঙালীর তৃতীয় হাত ।। সিরাজের দরবার ।।
অতঃপর শব্দায়ন
সভ্যতা এগিয়েছে, বাঙালীও এগিয়েছে অনেকটা দূর। পরিবর্তন এসেছে তাঁদের জীবনযাপনে। কিন্তু এই পরিবর্তনের সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের নতুন একটি হাতের। সিরাজের ভাষায় যাকে বলা যেতে পারে ‘বাঙালীর তৃতীয় হাত’। এই ’তৃতীয় হাত’ আসলে কী? এই হাতের মাধ্যমে বাঙালী করেটা কী? জাহাপনা এই হাত বলতে কী বুঝাতে চেয়েছেন? ‘বাঙালীর তৃতীয় হাত’ এই সব প্রশ্নেরই সামগ্রিক অ্যাখ্যান।
বাঙালির তৃতীয় হাত।। সিরাজের দরবার।।
হ্যালো বন্ধুরা! সবাইকে সিরাজের দরবারে স্বাগতম। খোশ আমদেদ। আমি সিরাজ। বাঙালিদের দেখতে সাধারণভাবে মানুষ মনে হলেই, দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখলে তার যে রূপ পাওয়া যায় সেটা অনেকটা এই চিত্রের মত। মানুষের হাত থাকে দুইটা, বাঙালির আছে তিনটা। ডান-বামের পরিবর্তে এই হাতের ব্যবহারে বাঙালি বেশ পারদর্শী। এই হাতের নাম অযুহাত। বাঙালি তার গোয়ার্তুমি, মূর্খতা, ব্যর্থতা ঢাকতে এই হাতের ব্যবহার করে থাকে। ইতিহাসের শুরু থেকেই, ইতিহাসের শুরু থেকেই এই হাতের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার তো বাঙালি করেও আসছে। বর্তমানেও এই হাতের ব্যবহার সর্বাধিক৷ যেহেতু এই হাত দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে হয়, তাই এমনিতে মনে হতে পারে সব স্বাভাবিক। কিন্তু দৃষ্টি একটু প্রখর করলেই আপনি এই হাত দেখতে পাবেন।
ধরুন, আপনি একজন অভিনেতা। অভিনেতা হিসেবে নিজেকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারছেন না। মানে নিজেকে অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। তো এখন আপনি কি করবেন? আপনি আপনার চারপাশের মানুষকে বলে বেড়াবেন “সময়টা ভাল যাচ্ছেনা। বাপ চাচা ছাড়া কি কোন কাজ হয়? ইন্ডাস্ট্রিতে যাদের চাচা, মামা, বাপ আছে তারাই রেফারেন্সে ভাল ভাল কাজ পায়।” অথচ, অথচ যে সময় নিজে পরিশ্রম করে নিজেকে যোগ্য অভিনেতা করার কথা সেই সময় আপনি বসে বসে স্বপ্ন দেখেছেন। শুধু অভিনেতা নয়, আপনি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা যে কেউ হতে পারেন। কিন্তু, আপনি যে সময় নিজেকে যোগ্য মানুষ হিসেবে তৈরি করার কথা তা না করে, নিজের ব্যর্থতার দায় হয় সময়ের ওপর, না হলে প্রতিষ্ঠানের ওপর, না হলে কোনো ব্যক্তির ওপর, এমনকি নিজের জন্মের ওপরও এই দায় চাপিয়ে দিতে আপনি দ্বিধাবোধ করবেন না। বলবেন অমুকের বাপ তমুক, তো তমুক হয়েছে অমুক। বা আক্ষেপ করবেন “আহ! প্রতিভা চিনল না বোকা বাঙালি”। তো কর্তৃপক্ষ যে এ হাতের ব্যবহার করে না, তা না। যে যার যার মত করে অযুহাত বাড়িয়ে বসে আছেন, ডান বামের পরিবর্তে এই হাত দেখিয়ে বসে থাকবে, মানে অযুহাত দেখিয়ে বসে থাকবে। ঘুষ নেওয়ার ব্যপারটা অনেকটা এইরকম। বাঙালির উত্তর তৈরি—বলবে “সিস্টেমটাই এমন! চাইলেই কি আর সৎ থাকা যায়?” গায়ক বলবে “ভাল গান কি কেউ আর লেখে?” গীতিকবি বলবে “ভাল গান কি কেউ বোঝে?” সংগীত পরিচালক বলবে “ভিন্ন দেশী অপসংস্কৃতিতে ভরে গেছে সারা দেশ।” লেখক বলবে “পাঠক কই?” পাঠক বলবে “ধ্যাত! ভাল লেখা তো কেউ লেখেই না।” মন্ত্রী বলবে “আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে। নাড়া দিয়েছি বলেই বিল্ডিং ভেঙে মানুষ মরেছে।” ইঞ্জিনিয়ার বলবে “ব্রিজ ভেঙেছে, মাটির গুণাগুণ নাই। ঠিকাদার, সে তো চুরি করে।” ঠিকাদার বলবে “ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তো নকল করে পাশ করেছে। লেআউটটাও ঠিকমত করতে পারেনি।” ডাক্তার বলবে “আমাদের এত রোগের চিকিৎসা করার সামর্থ্য নেই।” পুলিশ বলবে “স্যার, স্যার, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সব জানে, স্যার।” আর আমজনতা বলবে “শীতের (মিউট) বাঁইচা থাকা দায়! মাস্ক দিয়ে কি হবে? আমাদের তো করোনা ফরোনা কিছু হয়নি। তাই বলে মাজারে যাবো না? হে হে... গাড়ি চলুক আর না চলুক, বাড়ি তো যাবই।”
দিনশেষে আসলে মানুষই মরবে, মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পলাশীর প্রান্তরে, পলাশীর প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখা বাঙালি যেমন হাজার হাজার অযুহাত ছিল, এখনও বাঙালিদের হাজার হাজার অযুহাত আছে। এই অজুহাতের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহারই বাঙালিদের ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ শেখায়। স্বার্থপর হতে শেখায়, সমাজ থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তোলে। কিন্তু, কিন্তু সমাজ সুস্থ না থাকলে যে পরিবার বা ব্যক্তিও অসুস্থ হয়ে যায় সে কথা এই বোকা বাঙালিদের কে বোঝাবে?