ফিকশন
কী উপায় জাঁহাপনা ।। সিরাজের দরবার ।।
অতঃপর শব্দায়ন
সময়ের হিসাবে বাংলা ও বাঙালী এগিয়েছে সভ্যতার পথে অনেকদূর। জীবন যাপনে এসেছে নানামুখী পরিবর্তন। তবুও নবাব সিরাজের সময় আর বর্তমান সময়ের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাষ্ট্রীয়-বৈশ্বিক টানাপোড়েন খুব বেশি দূরবর্তী নয়। আছে কোম্পানির রক্তচক্ষু আছে সাম্প্রদায়িক ভয়। সেইসাথে আছে বাঙালীর তামাশা দেখে যাওয়া চিরকালীন স্বভাব। কী উপায় জাঁহাপনা সেই প্রসঙ্গের কল্পিত বয়ান।
কি উপায় জাঁহাপনা।। সিরাজের দরবার।।
হ্যালো বন্ধুরা! সবাইকে সিরাজের দরবারে স্বাগতম। খোশ আমদেদ। আমি সিরাজ। গোপাল ভাঁড় এর কন্টেন্ট দেখতে খুব মজা লাগে, তাইনা? আর কৃষ্ণচন্দ্র? তাকে দেখতে তো খুব সাদাসিধা আর বেকুব টাইপের মনে হয়। কন্টেন্টের এই একটাই ঝামেলা, যেটা মজা দেওয়ার জন্য তৈরি সেটা কেবল জোর করে মজা দেওয়ার চেষ্টা আর যেটা সিরিয়াস টাইপের সেটা শুধুই সাসপেন্স। কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে দেখতে যেমন সাদাসিধা আর বেকুব টাইপের মনে হয় আসলে কিন্তু তা না। পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সাথে থেকে সহযোগিতা না করলেও ইংরেজ এবং কৃষ্ণচন্দ্রের মাঝে একটা যোগসাজস ছিল। মীর জাফর আর তার সৈন্যরা যেমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখা বাঙালি, কৃষ্ণচন্দ্র হচ্ছে দূরবর্তী তামাশাখোর বাঙালি। কৃষ্ণচন্দ্রের মত এমন দূরবর্তী তামাশাখোর বাঙালির সংখ্যা কিন্তু কম নয়। আপনাদের চারপাশে একটু চোখ, কান, নাক খোলা রাখলেই এমন দূরবর্তী তামাশাখোর বাঙালি দেখতে পারবেন। সেদিন একটা সংবাদ বিশ্লেষণ দেখলাম, যেখানেই যারা সংখ্যালঘু সেখানে তাদের ওপর নাকি চলে নির্যাতন। বাংলা হয়েছে দুটো। এদিকে এরা মরে তো ওদিকে ওরা। দিনশেষে আসলে মানুষই মরে— একথা কেউ বলেনা। সে যাই হোক! যারা এই ঘটনাগুলো শুধু শোনে, কিন্তু প্রতিবাদ করেনা, তারাই কৃষ্ণচন্দ্রের মতো দূরবর্তী তামাশাখোর বাঙালি। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে আর মজা নেবে। যেন কিছুই হয়নি, সব স্বাভাবিক। মানুষে মানুষে যদি সম্মান না-ই দিতে জানে সে আবার কিসের মানুষ! আজ সাইজি! মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
একটা লিস্ট করেছি। অনেকের সাথেই কথা বলতে হবে। তো প্রথমে ঘর থেকেই করেছি শুরু। সেইদিন এসেছিল তিতু। আরে তিতুমীর! মীর নেসার আলী। এখনও তো ফেইজবুকে কি একটা পেইজ চলে—বাঁশের কেল্লা। ফালতু! তিতু নিজেও সেটা পছন্দ করেনা। হে হে.. তো সেদিন তিতুর সাথে দেখা। তিতু বলল, “জাঁহাপনা, আমরা তো শুধু আন্দোলন করেছি জমিদারের শাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। কিন্তু এরা তো দেখি ধর্মপ্রচার আর ব্যাংক ব্যবসা একসাথে শুরু করেছে।”
“বিস্তারিত বলো।”
“আজ্ঞে জাঁহাপনা, আমরা চেয়েছিলাম বাঙালিরা ধর্ম-কর্ম করে সাচ্চা মুসলমান হয়ে উঠুক। ইবাদত করুক নিয়ম মতো, দাড়ি রাখুক দেড় মুঠো। আর জমিদারের থেকে নিস্তার পাক গরীব দুঃখী মুসলমানেরা। কিন্তু এরা তো দেখি আমাদের থেকেও এক কাঠি সরেস। এদের ব্যালেন্স আছে, ব্যবসা আছে...”
“আর কিছু বলতে হবে না, তিতু। খামোশ! বুঝে গেছি তোমার মনোবাঞ্ছনা, কেন তুমি নাখোশ। শোনো তিতু, কোম্পানিকে দেশছাড়া করার আন্দোলনে তোমার অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু দোষ তোমারও ছিল। ধর্ম-কর্ম করবে যে যার যার মত। তুমি কে হে তিতু, কোনটা শুদ্ধ কোনটা অশুদ্ধ বুঝায়ে দেওয়ার। ছাড়নি তো ফকির বাউলদেরও। তারই খেসারত দিচ্ছে আজ বাংলাদেশও।”
“আজ্ঞে জাঁহাপনা, এ দায় তো আমরা নেব না।”
“এ দায় তো নিতেই হবে, সে তুমি যা-ই বল না। যে আশায় গড়েছিলে সোনার পুতুল সে-ই আজ দৈত্য হয়ে ধ্বংস করছে সোনার মহল।”
“আজ্ঞে জাঁহাপনা, এই ফকির বাউলেরা তো একটু বেশি বুঝে।”
“ঠিক আছে। তাহলে বসায়ে দিব নে একদিন সাইজির সাথে। কত জান জ্ঞানের কথা দেখা যাবে।”
“আজ্ঞে জাঁহাপনা, সাইজির সামনে পড়লে একটু বাঁচায়ে দিয়েন।”
“রবির বড়ভাই জ্যোতিকে এখন গান শিখাইতে ব্যস্ত আছে সাইজি। তবে তোমার ভূত বাংলা ছাড়ার একটা ব্যবস্থা করতে হবে শিগগিরই।”
এই দেখুন, বলতে বলতেই ভুলে গেছি। ক্লাইভের কল! তো ক্লাইভ মাঝেমাঝেই কল দেয়, কান্নাকাটি করে। বলে ইতিহাস নাকি তাকে ক্ষমা করেনি, বলে “ইওর ম্যাসেস্টি, আপনার অনেক বড় ক্ষতি কইরা ফেলিয়াছি।” এই হাবিজাবি কত কি! আমি বলি “দেখো বাপু, এসব বলে আর লাভ কি! তোমার কোম্পানি তো হচ্ছে একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তোমার কি দোষ! সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাজই হচ্ছে মুনাফা বাড়ানো। আর এই দেখ, প্রত্যেকটা কোম্পানিই এখন হচ্ছে একেকটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আর তোমরা তো শুধু ভারতবর্ষ দখলে নিয়েছিলে, এখন তো সারা পৃথিবীই দখল করে আছে মাত্র ৫টা কোম্পানি। এই যে আপেল, কমলা এগুলো আর কি। তো এই অদৃশ্য দখলদারির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখা বাঙালি এখন করবে কি! তুমি তো বাপু মাফ চেয়েই খালাস। কিন্তু বাঙালির বোকামির হবেটা কি?