ফিকশন
হুজুর হাজির ।। সিরাজের দরবার ।।
অতঃপর শব্দায়ন
বাংলা বাঙালী ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অবিষ্মরণীয় ট্র্যাজিক হিরো নবাব সিরাজউদ্দৌলা। এই জনপদের শেষ স্বাধীন নবাব হওয়ায় তাকে নিয়ে মানুষের রয়েছে ভিন্নমাত্রার আগ্রহ। রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ও স্বার্থন্বেষী মহলের নির্মিত ইতিহাস, কেচ্ছা কাহিনী ও গুজব। বাঙালীর আত্মপরিচয় বিনির্মাণে এই সকল বয়ানের সাথে সাথে এই সময়কে বুঝতেও নবাব সিরাজ গুরুত্বপূর্ণ। নতুন করে পুরাতনকে পাঠ করতে করতে আমরা বুঝে নিতে চাই আমাদের ললাট লিখন। আর তাই সিরাজের দরবারের এই পর্বে 'হুজুর হাজির'!
হুজুর হাজির।। সিরাজের দরবার।।
হ্যালো বন্ধুরা! সবাইকে সিরাজের দরবারে স্বাগতম। খোশ আমদেদ। আমি সিরাজ। মির্জা মুহম্মদ সিরাজ-উদ-দৌউলা। বাংলার, বিহার, উড়িষ্যার মহান অধিপতি, তোমার দেওয়া শেষ উপদেশ ভুলিনি জনাব। পরি.. হে হে হে!
অনেকদিন চর্চা নেই তো তাই ভুলে গেছি আর কি। তো দরবার! রাজদরবার বলতে আপনাদের মনে হতে পারে যেখানে রাজা, উজির, নাজির, সভাসদ উপস্থিত। কিন্তু এখন তো আধুনিক সময়। এই সময়ে সিরাজ রাজ্যহীন, মুকুটহীন। দরবার বলতে এখন তাই এই ভিডিও ভ্লগিং। ওই একটা ডিভাইস থাকলেই হয়ে যায় আর কি! তো নতুন এই সময়ে, নতুন এই দরবারে সবাইকে সুস্বাগতম!
তো প্রজারা, মানে বন্ধুরা, ১৭৫৭ সালের পরে কেউ কান্নায়, কেউ হতাশায়, কেউ ভালবাসায় আমাকে স্মরণ করেছেন। আমি হাজির হতে পারিনি, উপস্থিত হতে পারিনি। এই নিয়ে আমার মনোব্যথা আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি আপনাদের সামনে আবার হাজির। যেহেতু আমাদের কোনো শাখা নেই তাই, সিন্স সেভেনটিন ফিফটি সেভেন, আপনাদের স্মরণ, অভিযোগের নোটিফিকেশন আমার কাছে চলে এসেছে। আমার দরবারে আপনাদের সব চিঠি, বার্তা, ইমেল জমা আছে। সবগুলোর জবাব দিতে না পারলেও, এর মধ্যে থেকে কিছু কিছুর জবাব আলবৎ করবো। সেই সাথে সিরাজ, মানে আমি, আমাকে নিয়ে যত নাটক, সিনেমা, বই, চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে সেগুলোও আসবে আলোচনায়। কোথাও যেমন মদ্যপ সিরাজ, কোথাও আবার লম্পট সিরাজ, কোথাও আবার হঠাৎ করে দেশপ্রেমিক সিরাজ, এগুলো নিয়ে একটু আলাপ করা যাবে আর কি। সেই সাথে আমি সিরাজ কেমন সিরাজ সেটাও তো জানা জরুরি। এত এত লাইভ, ওয়েবিনার, কন্টেন্ট! হোক না হয় আরেকটা বেশি।
২৬৪ বছর হয়ে গেছে কত কত কাজ জমে আছে। আমার যৌনতার এই... মানে আমার মৌনতার এই শেষ! আমি আবার সরব। পুরাতন ফাইলপত্র খোলার আগে, যে প্রশ্নটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি এসেছে সেটা হল কেন ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে আমি ইংরেজদের ৩ হাজারকে সৈন্যকে পরাজিত করতে পারিনি। আপনারা অনেকেই এই প্রশ্নটা করেন। রীতিমত আক্ষেপ ঝাড়েন। আমি আপনাদের একটা ভুল ভাঙাতে চাই। সেটা হল, আপনারা জেনেছেন পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে। কিন্তু এটা ভুল কথা। ইংরেজরা না, আমাকে পরাজিত করেছে বাঙালিরা। মানে আপনাদের পূর্ব পুরুষরা। একবার ভেবে দেখুন কিভাবে আমার ৫০ হাজার সৈন্যকে ইংরেজদের মাত্র ৩ হাজার সৈন্য পরাজিত করতে পারবে। ক্লাইভ, মানে রবার্ট ক্লাইভ, সে-ও তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যতজন বাঙালি পলাশীর প্রান্তরে উপস্থিত ছিল আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে তারা প্রত্যেকে একটি করে পাথর নিক্ষেপ করলেও ইংরেজরা পরাজিত হয়ে যায়।
এই তো সেদিন কেউ একজন হঠাৎ করে ছড়িয়ে দিল চাঁদে নাকি কোন হুজুরকে দেখা যাচ্ছে। ওমনি হুজুগে বাঙালি কোনকিছুর বিচার বিশ্লেষণ না করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল চাঁদে হুজুরকে দেখার জন্য। এদের জীবনে হুজুগের প্রভাব এতটাই শক্তিশালী যে, কেউ কেউ দাবিও করতে লাগল “আমি দেখেছি চাঁদে হুজুরকে”, “আমি দেখেছি চাঁদে হুজুরকে”। কোনকিছু না জেনে, না বুঝে, কৌতুহলবশত, হুজুগের ঠ্যালায় বাঙালি এমন কোন কাজ নেই যেটা করতে পারেনা। যেমনটা করেছিল পলাশীর প্রান্তরে। কোনকিছুর বিচার বিশ্লেষণ না করে, পরে কি হবে সেটা না ভেবে শুধু মীরজাফরের কথায় পলাশীর প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে আর আমাকে পরাজয়ের দিকে ধাবিত করেছে। একটা গুজবপ্রিয়, অথর্ব, তামাশাখোর জাতি! আমার কথা হল বাঙালিরা হচ্ছে হাজার বছর ধরে তামাশাখোর জাতি। তামাশা দেখতে দেখতে কখন যে হেরে বসে আছে সেটাই বুঝতে সময় লেগেছে দু’শ বছর। তারপর এই বাংলাদেশ! আবার তামাশা! কবে যে ঘোর কাটবে কে জানে! (মোবাইল ফোনে রিংটোন বাজছে) এই... হে হে! ওহ হো! ক্লাইভ! এখন যদি ক্লাইভের ফোন না ধরি তাহলে সে দ্বিতীয়বারের মত আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে। তো বন্ধুরা, আজকের মত এখানেই (মিউট)। দেখা হবে পরের পর্বে। (ফোনে কথা বলতে বলতে) তো ক্লাইভ, বল। আচ্ছা তোমরা তো পলাশীর প্রান্তরে গুজব ছড়িয়ে দিলেই পারতা!